বত্রিশ বছরের যুবকটি ভুগছিলেন আচমকা শুরু হওয়া তীব্র পেটব্যথায়। চিকিৎসা চলছে। কিন্তু এনআরএস থেকে ন্যাশনালে এসেও শারীরিক কষ্টের কোনও নিবৃত্তি হয়নি। উল্টে কষ্ট আরও বাড়ছে। এই সময়ই হাসপাতালের জুনিয়র হাউস স্টাফ শ্রীজিতা লক্ষ করেন রোগীর দু’চোখের পাতা পড়ে আসছে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি বুঝে যান, ঘটনা কী। দশটি অ্যান্টি ভেনাম চালাতেই নতুন জীবন ফিরে পেলেন ওই যুবক। জানতে পারলেন, কোনও বদ হজম, গ্যাস-ট্যাস নয়। তাঁকে কামড়েছিল সাপে! কালাচ সাপ। ইংরাজিতে যার নাম কমন ক্রেট। নামে ‘ক্রেট’ বা কেউটের চিহ্ন থাকলেও পরিচিতিতে কেউটের গ্ল্যামার নেই।
আর একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। হরিণঘাটা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এক বছর পনেরোর কিশোর ভর্তি হয়। একই লক্ষণ। পেট ব্যথা। চোখ বুজে আসছে। এক মহিলা চিকিৎসক লক্ষণ দেখে বুঝে যান, কালাচের কামড় থেকেই এই অসুস্থতা। কিন্তু ছেলেটির বাড়ির লোক মানলে তো! সাপ কামড়েছে, দাগ কই? তার পর ‘কালাচ’ নামটা শুনে যথারীতি সন্দেহ। এ আবার কী নাম? অবশেষে ছবি দেখানো হল। কালো লিকলিকে চেহারা। কালো রংকে পাক খেয়ে সাদা সাদা চুড়ির মতো দাগ। তখন জানা গেল, ওই এলাকায় এটা ‘ঘামচাটা’ নামেই পরিচিত।
কালাচ সাপ! শুনলেই লোকজন ভুরু কুঁচকে তাকান। আসলে বিষধর সাপের যে এলিট ক্লাস, তার মধ্যে এই সাপের নামটি তেমন প্রচলিত নয়। অথচ এদের বিষ কিন্তু শঙ্খচূড়, কেউটে বা অন্য বিষাক্ত সাপের থেকে বেশি তীব্র। পশ্চিমবঙ্গে গড়ে প্রায় একহাজার মানুষ এই সাপের কামড়ে মারা যান প্রতি বছর। কিন্তু তবু, কালাচের ইমেজ আমজনতার কাছে অতটা ভীতিপ্রদ নয়। তার কারণ, এদের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য এমনই যেটা অন্য বিষধর সাপেদের সঙ্গে মেলে না। প্রথম কথা, এই সাপ ফণাহীন। দ্বিতীয়ত, এই সাপ কামড়ালে ব্যথা হয় না। জায়গাটা ফোলেও না। ফলে যাকে কামড়াল, সে বুঝতেও পারে না। অথচ আস্তে আস্তে নার্ভবিষের লক্ষণগুলি দেখা যায়। শুরু হয় পেটে ব্যথা, গলায় ব্যথা কিংবা সারা শরীর জুড়ে অস্বস্তি। যেন জ্বর আসছে। চিকিৎসা সময়মতো শুরু না হলে অবধারিত মৃত্যু।
আর এইখানেই শুরু হয় গণ্ডগোল। রোগীর বাড়ির লোককে বোঝানোই কঠিন হয়ে যায়, আপনাদের রোগীকে সাপে কামড়েছে। তাঁরা মানতেই চান না। পরিস্থিতি হয়ে ওঠে ওঠে জটিল। তার ওপর ‘কালাচ’ নামটাও অনেক জায়গায় অন্য নামে পরিচিত। ফলে তাঁরা চিকিৎসকের কথায় আগাগোড়া অবিশ্বাস করার সুযোগ পেয়ে যান। ঠোঁট বেঁকিয়ে বলতে পারেন, ‘‘এমন সাপের নাম জন্মেও শুনিনি।’’ আসলে সারা বাংলা জুড়ে কালাচের নানা নাম। কালোর ওপরে চিত্র আঁকা, তাই এর নাম কালচিতি। সেখান থেকেই কালাচ। কিন্তু এই নাম ছাড়াও আরও নাম আছে। শিয়রচাঁদা, নিয়রচাঁদা, ডোমনাচিতি, শাঁখাচিতি। এর মধ্যে নিয়রচাঁদার উল্লেখ মহাশ্বেতা দেবীর ‘হারুন সালেমের মাসি’ গল্পে আছে
কোনও কোনও জায়গায় আবার এরই নাম ঘামচাটা। মানুষের ঘামের গন্ধে এরা বিছানায় উঠে আসে, এমন এক প্রচলিত ধারণা থেকেই এমন নাম। যদিও এর কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। তবে এরা যে মানুষের সাহচর্য ভালবাসে, সেটা সত্যি। আর তাই নির্জন রাতে উঠে আসে বিছানায়! তার পর কামড় দিয়ে পালায়। রোগী টেরও পায় না। বড়জোড় একটা অনুভূতি হয় মশা কামড়ানোর মতো। তার পর সকাল থেকেই শুরু পেট ব্যথা।
তবে শুধু কালাচ নয়, সারা দেশের সামগ্রিক সর্পাঘাতের চিকিৎসার চিত্রটাই অত্যন্ত করুণ। কিন্তু আশার কথা, গত এক দশকে পরিস্থিতি অনেক বদলেছে। আর এই বদলের পিছনে সবচেয়ে আগে করা উচিত চিকিৎসক দয়ালবন্ধু মজুমদারের নাম। পেশাগতভাবে চক্ষু চিকিৎসক। কিন্তু তিনি এ রাজ্যে সর্পাঘাতের চিকিৎসার একজন রিসোর্স পার্সন। নিজের চিকিৎসাক্ষেত্রের পাশাপাশি তিনি নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছেন এই ক্ষেত্রটিতেও। কেন তিনি সর্পাঘাতের চিকিৎসার ব্যাপারে এমন উৎসাহী হলেন?
দয়ালবন্ধু জানাচ্ছেন, ‘‘হাবড়া স্টেট জেনারেল হাসপাতালের চোখের ডাক্তার ছিলাম। জানেনই তো, এই ধরনের হাসপাতালে সব ডাক্তারকেই এমারজেন্সি পেশেন্ট অ্যাটেন্ড করতে হয়। স্নেকবাইট কেসও আমাদেরই দেখতে হত। অথচ দেখতাম সবাই যে যার মতো করে চিকিৎসা করছে। কোনও স্ট্যান্ডার্ড ট্রিটমেন্ট গাইডলাইন বলে কিছু নেই। কোনও প্রোটোকল নেই। অথচ এটা কত গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়।’’
বিষয়টি কীরকম অবহেলিত সে বিষয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে তিনি দেখতে পান, সরকারি হিসেব অনুযায়ী ২০০৫ সালে ভারতে সাপের কামড়ে মারা গিয়েছেন পঞ্চাশ হাজার মানুষ। অস্ট্রেলিয়া, যেখানে সাপের সংখ্যা ভারতের থেকে বেশি, সেখানে সাপের কামড়ে মৃত্যুর সংখ্যা মাত্র এক! ক্রমশ তিনি বুঝতে পারেন আসল সংখ্যাটা পঞ্চাশ হাজারেরও অনেক বেশি। কেননা, আমাদের দেশে অনেক সাপে কামড়ানো রোগীকে হাসপাতালে আনাই হয় না। ওঝার কাছে নিয়ে চলে যাওয়া হয়। আর তার পর তো রয়েছেই কালাচ সাপের কীর্তি। বাড়ির লোক ভাবল, বুঝি পেটের বা শরীরে কোনও অজানা সংক্রমণেই মৃত্যু হয়েছে।
‘‘এইসব সংখ্যা ধরলে আসল সংখ্যাটা কত ভাবতেও ভয় করে!’’ বিষণ্ণ সুরে বলছিলেন দয়ালবন্ধুবাবু, ‘‘ম্যালেরিয়া বা টিবি নিয়ে কত প্রচার হয়! কিন্তু সাপের ক্ষেত্রে তেমন প্রচার হয় কি? এগুলো থেকেই আমার জেদ চেপে যায়। কাজ শুরু করি।’’
তাঁর পরিকল্পনাতেই স্বাস্থ্য ভবনে প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু হয় সর্পাঘাতের চিকিৎসার। যাঁরা শিখলেন, তাঁরা বিভিন্ন জেলায় ঘুরে বেরিয়ে বাকিদের শেখাতে শুরু করলেন। তৈরি হয় ট্রেনিং মডিউল। সর্পাঘাতের চিকিৎসার জন্য এমন মডিউল ভারতের কোনও রাজ্যে নেই। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি বদলেছে। নিজেরই অনেক শিষ্যের কৃতিত্বের কথা বলতে গিয়ে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে দয়ালবন্ধুবাবুর মুখ, ‘‘বর্ধমানের ভাতার, হুগলির সিঙ্গুর বিভিন্ন জায়গায় নতুন ছেলেদের কাজ দেখে চমকে গেছি। কী চমৎকার ডায়াগনসিস করছে এঁরা। কত কম পরিকাঠামো নিয়েও সাফল্য পাচ্ছে।’’
কিন্তু সামগ্রিক ছবিটা এখনও যথেষ্ট খারাপ। সকলের মধ্যে সচেতনতা আরও বাড়াতে বদ্ধপরিকর দয়ালবন্ধুবাবু। রেডিও, টিভি, ডিজিটাল মাধ্যম- সব ক্ষেত্রকে কাজে লাগিয়েই জনসচেতনতা বাড়াতে চাইছেন তাঁরা। কিন্তু কাজটা যে কঠিন, সেটা তিনি জানেন। অকারণে ভয় পেলে যে চলবে না, মনে করিয়ে দেন সে কথাও। বলেন, ‘‘লোকে কালাচকে কালচিতি বলে। কাছাকাছি নামের আরেকটা সাপও আছে। ঘরচিতি। এর কিন্তু একেবারেই বিষহীন। কিন্তু লোকে একেও বিষাক্ত মনে করে মেরে ফেলে। অথচ চেহারায় কিন্তু কোনও মিল নেই।’’ অকারণ ভয় নয়, ঠান্ডা মাথায় তার মোকাবিলা করাই যে বুদ্ধিমানের কাজ সেটা মনে করিয়ে দেন তিনি। তাই কালাচের কামড়ের লক্ষণগুলি আরও একবার মনে করিয়ে দেন। জানান, রহস্যময় এই সাপ যেহেতু অন্য সাপের কামড়ের মতো চিহ্ন রেখে যায় না, তাই এই লক্ষণগুলি মাথায় রাখতেই হবে।